রাজ্য সরকারি কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ নিয়ে আইনি লড়াই এক নতুন মোড়ে দাঁড়াল। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা আর হল না। বেঞ্চ গঠন না হওয়ায় মামলাটি পিছিয়ে গেল এবং এই কারণে সরকারি কর্মীদের আশায় জল ঢালল। বহু মাস ধরে চলতে থাকা এই মামলায় বারবার তারিখ পিছিয়ে যাওয়ায় কর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পরবর্তী শুনানি আগামী ৯ অথবা ১০ সেপ্টেম্বর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তা রাজ্য সরকারি কর্মীদের মানসিকভাবে আরও চাপে ফেলছে।

আইনজীবীর বক্তব্য ও হতাশা

এই মামলায় রাজ্য সরকারি কর্মীদের পক্ষের আইনজীবী, প্রখ্যাত আইনজীবী এবং রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য স্পষ্ট করে বলেছেন, রেজিস্ট্রি বিভাগের গাফিলতির কারণে শুনানি পিছিয়ে গেছে। তাঁর মতে, এমনটা হওয়া স্বাভাবিক নয় এবং এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিচারব্যবস্থা ধীর গতিতে চলছে। তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে ধীরগতির মধ্যেও বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে এবং সেই ব্যবস্থাই দেশকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে রক্ষা করছে। তাঁর কথায়, আজকের দিনে আদালত না থাকলে সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হত এবং কোনো প্রতিরোধ করার উপায় থাকত না।

সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

বিকাশ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই ডিএ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। কর্মীদের ন্যায্য প্রাপ্য আটকে রেখে সরকার নানা প্রকল্প ও অনুদানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে একটি স্পষ্ট প্রশ্ন—যখন সরকার দুর্গাপুজোতে কয়েকশো কোটি টাকা অনুদান দিতে পারে, তখন কর্মীদের বেতন কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে এত অনীহা কেন? তিনি সরকারের অগ্রাধিকার নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। সাধারণ কর্মীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ যখন লাগামছাড়া, তখন তাদের আর্থিক প্রাপ্যতা আটকে রাখা শুধু অবিচারই নয়, বরং প্রশাসনিক উদাসীনতার প্রমাণ।

কর্মীদের আন্দোলনের ডাক

আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য শুধু আদালতের ভরসায় বসে থাকতে রাজি নন। তিনি সরকারি কর্মীদের উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে একতা ও আপোষহীন আন্দোলনের মাধ্যমেই ন্যায্য প্রাপ্য আদায় সম্ভব। আদালতের পাশাপাশি রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পুলিশের প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য কর্মীদের প্রস্তুত থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। আদালতে মামলা চলবে, কিন্তু আন্দোলন না থাকলে সরকারের নীতি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও কর্মীদের হতাশা

এই মামলায় বারবার তারিখ পিছিয়ে যাওয়ায় কর্মীদের মধ্যে হতাশা দিন দিন বাড়ছে। বহু পরিবার শুধুমাত্র ডিএ না পাওয়ার কারণে আর্থিক সংকটে ভুগছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, ফলে সংসার চালানো আরও কঠিন হয়ে উঠছে। সরকারি কর্মীদের একাংশ জানিয়েছেন, ডিএ না পাওয়ার কারণে তাঁদের বেতন বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। এতে কর্মীদের জীবনযাত্রার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সরকারের প্রতি তীব্র সমালোচনা

বিকাশ ভট্টাচার্যের সমালোচনা এখানেই শেষ নয়। তিনি বলেন, সরকার যদি সত্যিই কর্মীদের পাশে থাকতে চাইত তবে এতদিনে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সরকার বারবার সময়ক্ষেপণ করছে। তাঁর মতে, সরকার আসলে অন্য দিকে নজর ঘোরাতে চাইছে। উন্নয়নের নামে প্রচার চলছে, কিন্তু কর্মীদের প্রাপ্য অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা স্পষ্ট। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে অ্যাজেন্ডা চালিয়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষ ভোটের সময়ে আবারও প্রভাবিত হবে।

ডিএ মামলার সামাজিক গুরুত্ব

ডিএ কেবল একটি অর্থনৈতিক দাবি নয়, এটি সরকারি কর্মীদের মর্যাদা ও ন্যায্যতার প্রশ্ন। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই ভাতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। মহার্ঘ ভাতা কর্মীদের বেতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হওয়া উচিত। ডিএ না দেওয়া মানে কর্মীদের জীবিকার মান কমিয়ে দেওয়া। এর প্রভাব পড়ছে তাঁদের পরিবারের শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচের ওপর। তাই এই মামলার নিষ্পত্তি শুধু কর্মীদের জন্যই নয়, সমগ্র রাজ্যের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্যও জরুরি।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ

আগামী দিনে এই মামলার রায় কী হবে তা নিয়ে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ। তবে বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য স্পষ্ট—কেবল আদালতের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, কর্মীদের নিজেদের দাবির জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, গণতন্ত্রে অধিকার আদায় করতে হলে আন্দোলনের বিকল্প নেই। আদালত ও রাস্তায় সমান্তরাল লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

ডিএ মামলা আরেকবার পিছিয়ে যাওয়ায় রাজ্য সরকারি কর্মীদের হতাশা বাড়ল বটে, তবে লড়াই থেমে নেই। বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এটি কেবল একটি আইনি মামলা নয়, বরং কর্মীদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। সরকার যদি কর্মীদের ন্যায্য দাবি মেনে না নেয় তবে আগামী দিনে বৃহত্তর আন্দোলন অনিবার্য। ডিএ শুধু একটি আর্থিক অনুদান নয়, এটি সরকারি কর্মীদের আত্মমর্যাদা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। আদালত ও আন্দোলন মিলেই এই লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।